1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পহেলা বৈশাখে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কমছে, বাড়ছে বৈষম্য

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৪ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশে উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতি দিন দিন বড় হচ্ছে। নানা ধরনের উৎসবে মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ করেন। তবে উৎসবকেন্দ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে।

https://p.dw.com/p/4ek7W
বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলা
বৈশাখের সময় গ্রামের মেলাগুলোতে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। ছবি: DW/M. M. Rahman

এ কারণে বাড়ছে বৈষম্য। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শহরের অর্থনীতিতে কিছু মানুষ ধনী হন। আর গ্রামের অর্থনীতিতে উপকৃত হন সবাই। গ্রামে বণ্টনের একটা নায্যতা আছে। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে আগে গ্রামে মেলা হতো। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এখন সেগুলো প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। ওই মেলাগুলোতে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো। এক সময় পহেলা বৈখাখে এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হতো। এখন অনেকটাই কমে গেছে।

কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে কাজ করেন অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "নগরায়নের ফলে গ্রামীণ কর্মকাণ্ড অনেক কমে গেছে। শহর কেন্দ্রিক সভ্যতার প্রসার ঘটছে। আগে ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে থাকতেন। এখন সেটা কমে এসেছে ৩০ ভাগে। পহেলা বৈশাখ বা বিভিন্ন উৎসবে গ্রামে যে মেলা হতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এখন সেগুলো ওভাবে হচ্ছে না। এক সময় পহেলা বৈশাখে এক হাজার কোটি টাকার কেনাবেচা হতো গ্রামে। সেটা এখন তেমন আর নেই। পহেলা বৈশাখ এখন অনেকটাই শহরকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আধুনিক নগর সভ্যতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটাই আমরা দেখছি। এই সরকার বলেছে, গ্রামে শহরের সুবিধার ব্যবস্থা করবে। এর অর্থ এই নয় যে, গ্রামের সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা এই ধরনের মেলা বন্ধ করে দিতে হবে। এটা অটুট রাখতে হলে সরকারের উচিত হবে নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে হলেও গ্রামীণ সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি শুধু শহরে হয় তাহলে সমাজে বৈষম্য বাড়ে। কিন্তু গ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমবণ্টন হয়। এতে উপকৃত হন সবাই।”     

'গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলে সামগ্রিক অর্থনীতি ভাল হয়'

বর্তমান সরকারের সময়ে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ সুবিধা সম্প্রসারণের ফলে গ্রামে ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কুটিরশিল্পের প্রসার ঘটেছে। কৃষির পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে হাঁস-মুরগি পালন, মংস্য চাষ, গবাদি পশু পালন ও নার্সারি স্থাপনে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন মানুষ। প্রত্যন্ত গ্রামে ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির খামার, শাকসবজি ও ফলের বাগান গড়ে তুলেছে সাহসী ও উদ্যমী যুবক-যুবতীরা। শহর থেকেও অনেকে গ্রামে গিয়ে নানা ধরনের কৃষি ফার্ম করছেন। কিন্তু গ্রামের মানুষের নিজেদের যে কাজগুলো সেগুলো দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্লাস্টিকের আগ্রাসনে কমে যাচ্ছে মৃৎ শিল্প। নানা ধরনের কারুশিল্পী কাজ করতেন। এখন তারাও নিজেদের কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মূঈদ রহমান দীর্ঘদিন ধরে উৎসবের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "এখন তো আমাদের মনে হয় গ্রামের মানুষ ভালো আছেন। কিন্তু গ্রামে যদি আগের মতো মেলা হতো, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলত তাহলে আরও ভালো থাকত।গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ে। ৭০ এর দশকে কে হিন্দু, কে মুসলমান সেটা ভাবা হতো না। আসলে সার্বিকভাবেই আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমে যাচ্ছে। এর ফলে আমাদের মধ্যে এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। আবার গত ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। সবাই এখন কিছু একটা পাওয়ার আশায় থাকে। অথচ এরশাদের শাসনামলেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলেছে। এই ধরনের প্রাপ্তির কথা আমরা চিন্তাই করতে পারতাম না। আমাদের পাঠ্যক্রমগুলোও বাঙালি সংস্কৃতির অনূকূল না। ফলে আমরা সাম্প্রদায়িক হয়ে যাচ্ছি। আমরা যদি গান না শুনি, নাটক না দেখি তাহলে আমরা রুক্ষ্ম হয়ে যাব। আমরা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি।”

'পহেলা বৈশাখ শহরকেন্দ্রিক হয়ে গেছে'

অধ্যাপক মূঈদ রহমান বলেন, "অর্থনীতি কী? কিছু উৎপাদন হবে, সেটা বিক্রি হবে। এটাকে বলে চলমান অর্থনীতি। এখন গ্রামে একটা মেলা হলে সেখানে কত কিছু উৎপাদন হয় এবং সেগুলো বিক্রি হয়। সেখানে কর্মসংস্থানও বাড়ে। এভাবেই অর্থনীতি সচল থাকে। শহর আর গ্রামের অর্থনীতির একটা পার্থক্য হল, শহরে মাথাপিছু আয় এক টাকা বাড়লে দারিদ্র কমে দশমিক ৭০ ভাগ। আর গ্রামে মাথাপিছু আয় এক টাকা বাড়লে দারিদ্র কমে দুই দশমিক ৪ শতাংশ। ফলে বোঝাই যাচ্ছে গ্রামের অর্থনীতিতে সমতা অনেক বেশি। শহরে একজন শিল্পপতির আয় যেভাবে বাড়ে শ্রমিকের সেভাবে বাড়ে না। সেটা সম্ভবও না। কিন্তু গ্রামের চিত্রটা পুরোপুরি ভিন্ন।”

বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখী মেলা গ্রামীণ অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সহায়তা করে। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব, প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। এই উৎসবে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করে। ফুটপাত থেকে বিপণিবিতান সবখানেই পণ্য বেচাকেনার ধুম পড়ে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বেচাকেনা বেড়েছে অনলাইনেও। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈশাখী উৎসব দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সর্বজনীন এই উৎসবে বাড়ছে মানুষের অংশগ্রহণ। সেইসঙ্গে বাড়ছে বৈশাখ কেন্দ্রিক কেনাকাটাও। এতে উৎসবের পাশাপাশি পয়লা বৈশাখ পাচ্ছে বাণিজ্যিক গুরুত্ব। বৈশাখী উৎসব ঘিরে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি এসেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেন, এই উৎসব সর্বজনীন।

অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু জিনিস হারিয়ে যাবে। তবে কিছু জিনিস আমাদের রক্ষাও করতে হবে। এটা শুধু আমাদের দেশে না, সারা বিশ্বেই এমন। আধুনিক সভ্যতার ফলে কিছু জিনিস হারিয়ে গেলেও বৈশাখী উৎসবটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। কারণ এই পহেলা বৈশাখের সঙ্গে

আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির একটা সম্পর্ক আছে। ফলে এটা আমাদের হারিয়ে ফেললে চলবে না।”