1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পহেলা বৈশাখ: আবার জমেছে বাঙালির আনন্দমেলা!

১৪ এপ্রিল ২০২৩

পুরানো গ্লানি ঝেড়ে নতুনের বার্তা নিয়ে এলো 'বাঙালির বড়দিন' পহেলা বৈশাখ। বাঙালি আজ বৈশাখের আনন্দে মাতোয়ারা।

https://p.dw.com/p/4Q2wN
বর্ষবরণের প্রভাতী আয়োজন চলে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপী
বর্ষবরণের প্রভাতী আয়োজন চলে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপীছবি: Zakir Hossain Chowdhury/AA/picture alliance

রঙিন আল্পনা দেশজুড়ে, হালখাতা হাতে দেনাদারের অপেক্ষায় ব্যবসায়ী, নারী-পুরুষ সেজেছে বর্ণিল পোশাকে, শিশু-বৃদ্ধার মুখে চেনা প্রাণোচ্ছ্বল হাসি। এইতো বাংলার মহাউৎসবের দিন।

নববর্ষের পঞ্জিকা পাতা উল্টাবার আগে বঙ্গবাজারে আগুন কিংবা মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতি যে হুমকি -সেসব ভুলে জাতি-বর্ণ-ধর্ম-গোত্র নির্বিশেষে মিলেছে প্রাণের উচ্ছ্বাসে! অতীতের জরা ঝেড়ে তাই তো রমনা বটমূলে সমবেত কন্ঠে সবাই গায় ‘নির্ভয় গান'।

সংগীত কথা ও সুর শুভশক্তি আর মঙ্গল কামনার বৈশাখী বার্তা যুগ যুগ ধরে দিয়ে চলেছে সংগীতায়ন ছায়নাট।

শুক্রবার নানা আঙ্গিকে বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী বর্ষবরণ শুরু হয়। আয়োজনমালার কেন্দ্রবিন্দুতে রাজধানীর রমনা বটমূল। নব আলো সন্ধান করার ডাকে ১৪৩০ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেয় ছায়ানট। প্রত্যাশা একটি বিভক্তিমুক্ত-শুভ মননের সমাজ এবং শুভ চিন্তার অগ্রসরমান নতুন বছর।

ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, সূর্যোদয়ের সঙ্গে আহির ভৈরব সুরে সারেঙ্গিবাদনের মধ্যে দিয়ে বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রভাতী আয়োজন। নাগমায় শিল্পী শৌণক দেবনাথ ঋকের সঙ্গে তবলায় সংগত করেন শিল্পী গৌতম সরকার। অনুষ্ঠানমালা সেজেছে ১০টি সম্মেলক গান, ১১টি একক গান, দুটি আবৃত্তি এবং সবশেষে জাতীয় সংগীতে।

"নববর্ষের সূর্যোদয়ের নবীনকিরণ যখন আমাদের আলোকিত করে, তখন ফিরে দেখি ফেলে আসা দিনগুলো। ধারাবাহিক অগ্রগতি দেশের ভবিষ্যতের পদরেখা হিসেবে আমাদের প্রাণে আশার সঞ্চার করে। অন্যদিকে লোভ, বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ও বৈষম্য আমাদের হতাশ করে সমাজে বিভাজন রেখাবে গভীর ও বিস্তীর্ণ করে আমাদের অর্জনগুলো ম্লান করে দেয়। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার সাহিত্য ও সংগীত সমাজের শুভশক্তিকে জাগ্রত করে সম্প্রীতির বন্ধনকে নিবিড়তর করে চলেছে। সারা দেশ জুড়ে এই ধারার গান ও পাঠ সমাজের বিভক্তি অতিক্রম করুক, অশুভ প্রবণতার বিনাশ ঘটাক, নূতন বছরের অগ্রসর চিন্তার ভিত্তি নির্মাণ করুক”। বৈশাখী কথন পর্বে এভাবে বলছিলেন ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা।

বর্ষবরণের প্রভাতী আয়োজন চলে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টাব্যাপী। যন্ত্রসংগীতে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হয় রবীন্দ্রসংগীত ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর'। পরে সেঁজুতি বড়ুয়া শোনান রবীন্দ্রসংগীত ‘মনমোহন। সিদ্দিকুর রহমান পারভেজ আবৃত্তি করেন ‘বৈশাখ'। একক কণ্ঠে পার্থ প্রতীম রায় শোনান ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে', মোস্তাফিজুর রহমান তূর্য শোনান ‘মোরে ডাকি লয়ে যাও'।

বড়দের দল গেয়ে শোনায় সম্মেলক গান ‘শুভ্র সমুজ্জ্বল হে চির-নির্মল'। পরে রেজাউল করিমের কণ্ঠে গীত হয় ‘ওগো অন্তর্যামী ভক্তের তব'। এরপর ছোটেদের দল সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনায় ‘মৃদুল মন্দে মঞ্জুল ছন্দে'।

এছাড়া একক কণ্ঠে ‘অন্তরে তুমি আছ চিরদিন' শোনান খায়রুল আনাম শাকিল; ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে' শোনান ইফ্‌ফাত আরা দেওয়ান; ‘স্বদেশ আমার! জানি না তোমার' শোনান মইদুল ইসলাম; ‘নিচুর কাছে নিচু হতে' শোনান ফারহানা আক্তার শ্যার্লি; ‘সবারে বাস রে ভালো' শোনান লাইসা আহমদ লিসা; ‘মন মজালে ওরে বাউলা গান' শোনান আবুল কালাম আজাদ; ‘মানুষ ছাড়া খ্যাপা রে তুই' শোনান মো. খায়রুল ইসলাম; ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে' শোনান চন্দনা মজুমদার।

সম্মেলক কণ্ঠে ছোটদের দল শোনায় ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান', ‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না', ‘এই আমাদের বাংলাদেশ', ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো'। বড়দের দল গেয়ে শোনায় ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব', ‘আমাদের নানান মতে'। মাহমুদা আখতার আবৃত্তি করেন ‘দ্বারে বাজে ঝঞ্ঝার জিঞ্জীর।

অনুষ্ঠানের শেষ অংশে যখন ছোট আর বড়দের দল মিলে সম্মেলক কণ্ঠে গায়ছিল শাহ আবদুল করিমের লেখা ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান' গানটি, ততক্ষণে নববর্ষের প্রথম ভোরের আলো পরিণত হয় গ্রীষ্মের ঝলসানো রোদে। তবুও হাজারো মানুষ সমস্বরে কণ্ঠ মিলিয়ে একসঙ্গে গেয়ে যান ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।”

ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের পর শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতাদের সম্মেলিত কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রথম আয়োজন। এটি সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার, দেখা যায় ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলেও।

করোনাভাইরাস মহামারীর সংকটি ফেরিয়ে এবার বিধি-নিষেধ ছাড়াই নববর্ষ পালন করছে বাংলাদেশ। সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর এ আয়োজনে একাত্মতা জানিয়ে সাজিয়েছে না বর্ণিল উৎসব। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে নতুন বাংলা বছরের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দুজনের শুভেচ্ছা বাণীতে ব্যক্ত করেন সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়।

কৃষি উৎসব বা রাজস্ব আদায়ের বিষয় হিসেবে বৈশাখকে সামনে এনে বাংলা সাল প্রবর্তিত হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশকে নানা সংকটে দিশা দেখিয়েছে পহেলা বৈশাখের উৎসব। অতীতে এসেছে সংস্কৃতিকে বদলে দেয়ার নানা রকমের বিপত্তি। তার ধারাবাহিকতায় এবারও চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দিয়ে চিরকুট এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা যদিও তা আমলে নেয়ার মতো নয় বলে জানান।

তবে মানতে হচ্ছে কিছু বিধি-নিষেধ। মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবারও কোনো মুখোশ মুখে পরা যাচ্ছে না, নেওয়া যাচ্ছে না ব্যাগ। তবে চারুকলা অনুষদের বানানো মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করা যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রিতে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ক্যাম্পাসে সব অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে বিকাল ৫টার মধ্যে। এ সময়ের পর কোনোভাবেই ঢোকা যাবে না, কেবল বের হওয়া যাবে। নববর্ষের দিন ক্যাম্পাসে যান চলাচলে রয়েছে বেশ-কয়েকটি বিধি-নিষেধ।

তারপরও হাতে হাত ধরে সববয়সি মানুষ মেতে উঠেছে পহেলা বৈশাখের উৎসবে। জরা ও অশুভশক্তির প্রতিবন্ধকতা ফিরিয়ে স্বত্বস্ফূর্তভাবে বাঙালি যে ফের একত্র হতে জানে, তার জন্যই কি না শিল্পী গেয়েছেন, “আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা...”।  

জেকে/ এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)