1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

রোজার আগে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে দুই পরিকল্পনা

হারুন উর রশীদ স্বপন (ঢাকা)
১৫ জানুয়ারি ২০২৪

ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। মার্চে পবিত্র রমজানের সময় খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। সেই লক্ষ্যে এবার দুটি পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা৷

https://p.dw.com/p/4bHOe
চালের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতি যে সামান্য কমে স্থিতিশীল হয়েছে তা কতটা ধরে রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে।
চালের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতি যে সামান্য কমে স্থিতিশীল হয়েছে তা কতটা ধরে রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে।ছবি: Abdullah Momin

দায়িত্ব নেয়ার পরই নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে সরকারের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন। আর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, দেশে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সোমবার ডয়চে ভেলেকে বলেন," আমরা অর্থ,  খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ শুরু করেছি। আশা করি, বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবো।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৪১ শতাংশ হয়েছে। এটা গত সাত মাসে সর্বনিম্ন। এই সময়ে খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্য বহির্ভূত পণ্যেও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৩ শতাংশ। নভেম্বরে কমে হয় ৯.৪৯ শতাংশ। গত এপ্রিলে এটি ছিল ৯.২৪ শতাংশ। কিন্তু মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৯৪ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্যমতে,  ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ, আগের মাসে যা ছিল ১০.৭৬ শতাংশ।

কিন্তু চালের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতি যে সামান্য কমে স্থিতিশীল হয়েছে তা কতটা ধরে রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে। আবার দুই মাস পর রোজা শুরু হবে।

গত দুই সপ্তাহে চালের দাম রকমভেদে দুই থেকে ছয় টাকা বেড়েছে। ঢাকার বাজাওে এক সপ্তাহ আগে আগে যে মোটা চালের কেজি ৫০-৫২ টাকা ছিল, তা এখন বিক্রি হ হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকায়। মাঝারি মানের চালের কেজি ৫৫-৫৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬২ টাকা। আর মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মতো সরু চাল ৬২-৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬৮ থেকে ৮০ টাকা হয়েছে। কিছু  বিশেষ ধরনের সরু চাল অবশ্য বিক্রি হচ্ছে আরো বেশি দামে।

কারওয়ান বাজারের সিরাজ অ্যান্ড সন্স রাইস এজেন্সির মো. খোকন মিয়া বলেন, " চালের কোনো ঘাটতি নেই। তাই হঠাৎ দাম বাড়া অস্বাভাবিক। যারা চাতালের মালিক এবং বড় বড় সরবরাহকারী, এটা তারা নিয়ন্ত্রণ করেন।”

 এই ভরা মৌসুমেও শীতের সবজির দাম বেশ চড়া। গোল আলুর কেজি এখন ৮০ টাকা, যা ক্রেতাদের বিস্মিত করছে। বেগুনের কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, বড় আকারের লাউ প্রতিটি ১০০ টাকা, টমেটোর কেজি ৬০ থেকে ৯০ টাকা, শিম ৯০ টাকা কেজি, মটরশুটি  কেজি ১৫০ টাকা কেজি, ফুলকপি বড় সাইজ ৬০ থেকে ৭০ টাকা প্রতিটি, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা কেজি, নতুন দেশি পেঁয়াজ কেজি ১০০ টাকা।গ রুর মাংসের দামে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। এখন কেজি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ( ক্যাব)-এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, "এখন চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই৷ এ বছর ধানের ভালো উৎপাদন হয়েছে। আলুর দাম বেড়ে গেছে। খেজুরের দাম রোজা আসার আগেই বেড়ে গেছে। এটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি। আর সামনে রোজা৷ পণ্য ঠিক সময়ে আমদানি করা না গেলে ব্যবসায়ীরা রোজার পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। তারা সব সময় অজুহাত খোঁজে। এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিকমতো কাজ করতে হবে। এখন নতুন মন্ত্রীরা কী করেন দেখি।''

রোজার মাসের প্রস্তুতি ও আশঙ্কা

প্রতি বছর রোজার মাসে বেশি চাহিদা থাকে তেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুর ও পেঁয়াজের৷ তাই এসবের দামও বেড়ে যায়। দাম বাড়িয়ে দেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে বছরে পেঁয়জের চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন । তার মধ্যে রোজায়  চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয় ছয় থেকে সাত লাখ টন। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। রোজার আগে যদি ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তুলে নেয়, তাহলে রোজায় পেঁয়াজের দাম আরো বাড়তে পারে।

বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। রোজার মাসে চাহিদা থাকে আড়াই থেকে ৩ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে ২ লাখ টনের কিছু বেশি উৎপাদিত হয়। বাকি ১৮ লাখ টন আমদানি করতে হয়। গত জুলাই থেকে গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত লাখ টন ভোজ্য তেল আমদানি করা হয়েছে। গত তিন মাসে আমদানি করা হয়েছে লাখ লাখ টন। তারপরও আমদানি না বাড়ালে ভোজ্য তেলের দাম বাড়তে পারে।

বছরে পরিশোধিত চিনির চাহিদা ১৮ লাখ।  রোজার মাসে চাহিদা থাকে তিন লাখ টনের। ১৯ লাখ টন চিনি আমদানি করতে হয় বছরে। এবার ডলার সংকটের কারণে চিনির আমদানি কম হয়েছে। তাই রোজার বাজারে  চিনির সংকট হতে পারে।

বছরে মশুর ডালের চাহিদা পাঁচ লাখ টন। রোজায় চাহিদা থাকে ৭০ হাজার টনের। প্রতিবছর তিন  লাখ ৫০ হাজার টন মশুর ডাল আমদানি করতে হয়। গত ছয় মাসে দুই লাখ টন আমদানি করা হয়েছে। মশুর ডালের দাম এখনই চড়া। রোজায় আরো বাড়তে পারে।

প্রতিবছর এক লাখ টন ছোলার চাহিদার মধ্যে রোজার মাসেই লাগে ৮০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে ছয় হাজার টন ছোলা উৎপাদন হলেও এক লাখ টন আমদানি করা হয়। গত তিন মাসে ৩০ হাজার টনের মতো ছোলা আমদানি করা হয়েছে। আরো ১৫ হাজার টন ছোলা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে  জানা গেছে। সরকার ছোলা আমদানিতে ভ্যাট কমিয়েছে। তারপরও বাজারে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই। গত এক মাসে ছোলার দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আর দেশে খেজুরের বছরে চাহিদা প্রায় এক লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রোজার মাসেই চাহিদা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন। এ পর্যন্ত ২৫ হাজার টনের এলসি খুলতে পেরেছেন ব্যবসায়ীরা। আমদানি হয়েছে ১৫ হাজার টন। পথে রয়েছে ১০ হাজার টন। রোজার আরো খেজুর আসবে। তবে এবার খেজুর আমদানি কম হচ্ছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং ( সাসেম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হা ন লেন ," মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও এতে স্বস্তির কিছু নাই। আশঙ্কার বিষয় হলো চালের দাম কোনো কারণ ছাড়াই বাড়তে শুরু করেছে। আর চাল মূল্যস্ফীতিতে বড় ভূমিকা রাখে। সামনে রোজা৷ এই সময়ে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে, বিশেষ করে৷ আমদানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।”

তার মতে, "বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দেয় প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। নিম্নবিত্ত মানুষ খাদ্যপণ্যসহ যেসব পণ্য কেনে, তার দাম বেশি। ফলে তাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি।”

তিনি বলেন, " বাজার মনিটরিং ছাড়াও এখন অর্থনেতিক সংস্কারগুলো দ্রুত শুরু করা উচিত। এখানে মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব আছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের একটা সংকট ছিল। এখন নতুন মন্ত্রিসভা দায়িত্ব নিয়েছে। তারা কতটা পারেন তা দেখার বিষয়।”

এ ব্যাপারে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা খাদ্য উৎপাদন এবং আমদানি মনিটরিং করছি। এজন্য অর্থ, বাণিজ্য, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ এবং খাদ্য চার মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছি। প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানিতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, কোথাও যাতে কোনো সংকট সৃষ্টি না হয় তা আমরা দেখছি। রমজান নয়, তার আগেই ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামবে। ভোক্তা অধিদপ্তর আরো সক্রিয় হচ্ছে। আমরা এবার আরো গভীরে যেতে চাই। খাদ্য মজুত যাতে ঠিক থাকে তার সব ব্যবস্থা করা হবে।”

তিনি বলেন," এবার জানুয়ারি মাসে এবং রোজার আগে এবং রোজার মাঝে আমরা ন্যায্যমূল্যে পাঁচটি ভোগ্যপণ্য দেবো এক কোটি পরিবারকে । আর আমরা আমদানীকারক, সরবরাহকারী সবার সঙ্গে এই সপ্তাহেই বসবো। আমাদের খাদ্য মজুত ঠিক আছে। কোনো সংকট নেই।”

চালের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এটা দেখে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবুও আমি খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি । আমরা এই সপ্তাহেই মিলার এবং হোল সেলারদের তিনি ডেকেছেন। আমিও থাকবো।”

তার কথা, "এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা । আমরা সবাই সেই চেষ্টা করবো।”

দাম বেশি চাইলে অভিযোগের সুযোগ

এদিকে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সোমবার সচিবালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর জানান, কোনো পণ্যের দাম বেশি নেয়া হলে জাতীয় তথ্য সেবা নাম্বার ৩৩৩-এ  অভিযোগ করা যাবে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এই সেবা চালু হবে।

প্রতিমন্ত্রীর এপিএস রাকিবুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রচলিত সেবার সঙ্গে ৩৩৩-এ এই সেবাটি নতুন যুক্ত হবে। নতুন একটি বাটন দেয়া হবে। ৩৩৩ এ ফোন করে ওই বাটন চেপে অভিযোগ জানানো যাবে। এরপর অভিযোগটি অভিযোগকারীর এলাকায় (ঘটনার এলাকা) ভোক্তা অধিদপ্তর, ম্যাজিষ্ট্রেট, মোবাইল কোর্ট বা পুলিশের কাছে পাঠানো হবে। তারা আইন মতো ব্যবস্থা নেবেন। অভিযোগকারীকে পুরো নাম ঠিকানা ও ফোন নাম্বারসহ অভিযোগ করতে হবে। অভিযোগের ডকুমেন্ট বা প্রমাণ থাকতে হবে।”

একই সময়ের মধ্যে  নতুন একটি ওয়েবসাইট খোলা হবে। সেখানে পণ্যের দাম, মজুতসহ বিভিন্ন তথ্য থাকবে বলে জানান তিনি।

২০২২ সালের ছবিঘর