মরিশাসের সেগা সংগীতের জয়গান গাইছেন নিকিতা

মরিশাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগীত হলো সেগা – যা মিশ্র ক্রেওল ভাষায় গাওয়া হয়৷ কিন্তু এই দ্বীপরাষ্ট্রের বাইরে সেই সংগীতের কোনো ভবিষ্যৎ আছে কি?

২০১৪ সালে সেগা সংগীত ইউনেস্কোর মানবজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে৷ লা নিকিতা সেই ধারার অন্যতম প্রধান ধারক ও বাহক৷ কিন্তু সেগা গানের বৈশিষ্ট্য কী? সেগা গায়ক হিসেবে লা নিকিতা বলেন, ‘‘জানেন, সেগা সংগীত আমাদের জনগণ, আমাদের সংগীত এবং আমাদের আনন্দের কাহিনি বলে৷ আমাদের পূর্বপুরুষরা সেগার তাল ও লয় সৃষ্টি করেছিলেন৷ দাসত্ব থেকে মুক্তি, স্বাধীনতা, নিজেদের কাহিনি, নিজেদের সংগ্রাম ফুটিয়ে তুলেছিলেন৷ আমরা এখনো সেগা গানে সংগ্রামের উল্লেখ করি বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে কিছু আনন্দ, উৎসব ও ভালোবাসার কথাও বলি৷''

লা নিকিতার কাছে সেগা সংগীতের থেকেও বড় কিছু৷ মরিশাসের মানুষ হওয়ার চেতনা ও দেশের ঐক্যের প্রতিফলন৷ তিনি মনে করেন, ‘‘সেগা যদি আমাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, তাহলে গোটা বিশ্বকেও ঐক্যবদ্ধ করতে পারে৷ মাইকেল জ্যাকসনের ‘উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড' গানের কথা মনে আছে? এবার হয়তো সেগা শৈলিতে, ক্রেওল ভাষায় সেই গান আবার সৃষ্টি করার সময় এসেছে৷ কেন সেটা হবে না?''

লা নিকিতা কীভাবে সেটা ঘটাতে চান? যেখানেই যান, সেগা-র জয়গান করেন তিনি৷ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক প্রবণতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি নিজের গান প্রাসঙ্গিক ও সবার ধরাছোঁয়ার মধ্যে রাখেন৷ বর্তমান প্রবণতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘মরিশাসে এখন আধুনিক সেগার চাবিকাঠি হলো ড্রাম৷ অনেক বছর আগে আমাদের শুধু রাভান ছিল৷ আজকাল আমরা রাভান ও ড্রাম একত্র করি৷ এটাই আমাদের আধুনিক সেগা৷ এই বাদ্যযন্ত্রের নাম মারাভান৷ মরিশাসে আমরা সেটাই বলি৷ লা রেউনিয়ঁ দ্বীপে আমাদের ভাইবোনেরা সেটাকে কাইয়ম্ব বলে৷ মাটিও ও মাশা সম্প্রতি সেখানে ট্যুরে গিয়েছিল৷ কেনিয়ার মানুষ এটিকে কাইয়াম্বা বলে৷ আফ্রিকার পূর্বে অনেক দেশে এই বাদ্যযন্ত্র দেখা যায়৷ তারাও বাজায় বটে, তবে সেখানে বাদ্যযন্ত্রের নাম ভিন্ন৷ এটি আইডিওফোন গোত্রের বাদ্যযন্ত্র. মরিশাসে আখের ফুলের ডাঁটি দিয়ে মারাভান তৈরি করা হয়৷ ভেতরে কিছু বীজ ভরে দেওয়া হয়৷ ফলে বিশেষ ধ্বনি সৃষ্টি হয়৷ এদের জন্য একটু মারাভান বাজাতে পারো৷

সেগা সংগীতের উপর আন্তর্জাতিক প্রভাব সম্পর্কে লা নিকিতা মোটেই চিন্তিত নন৷ তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘‘আজকাল সংগীতের এত ধারা হয়েছে৷ আমরা সেগার মধ্যে সেগুলি শামিল করি৷ আমাদের সেগা ব্লু, সেগা জ্যাজ আছে৷ ইলেকট্রো মিউজিক, নাচের মিউজিকের প্রভাব রয়েছে৷ আজকাল মরিশাসের তরুণ প্রজন্ম কিছুটা ক্যারিবীয় ছন্দের শাতা মিউজিকের সঙ্গে সেগা চর্চা করছে৷ আমাদের আফ্রো মিউজিকও আছে৷ এই সব আমাদের সেগা সংগীতকে জীবন্ত রাখে৷ সেটা মরিশাসে সেগার সুরক্ষার অংশ৷ সংগীতের ধারা যাই হোক না কেন, সেগা আমাদের পরিচয় থেকে যাবে৷ মরিশাসের প্রতিটি মানুষের হৃদস্পন তার মধ্যে রয়েছে৷''

লা নিকিতা তাঁর কণ্ঠ, তাঁর গান, তাঁর টিভি ও রেডিও শো কাজে লাগিয়ে সেগার ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখছেন৷ বাকি বিশ্বেও সেই ধারার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন তিনি৷ লা নিকিতা বলেন. ‘‘বিশেষ করে যে সব নারী আমার আগে সেগা পরিবেশন করেছেন, তাদের কাছ থেকে আমি প্রেরণা পেয়েছি৷ তাদের সময়ে সেগা মোটেই ভালো চোখে দেখা হতো না৷ মেয়েরা সে গান গাইলে সবাই তাদের ‘চোলো' অর্থাৎ খারাপ বলতো৷ আজকাল এমন সমস্যার কথা ভাবা যায় না৷ আমি আজ তরুণী হিসেবে এখানে দাঁড়িয়ে সেই নারীদের জন্য গান গাওয়ার সময়ে এটাকে এক শক্তি, এক ঐতিহ্য হিসেবে দেখছি৷ তাদের ধারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি৷ সেইসঙ্গে তরুণী গায়িকা হিসেবে আমিও হয়তো সেই সব কমবয়সিদের জন্য একই কাজ করতে পারি, যারা হয়তো সেগা গাইতে সংকোচ বোধ করছে বা শুধু ক্লাসিকাল গান গাইতে চাইছে৷ আজকাল আমার কাছে সেগা নাচ ও গানসহ  পারফর্মিং আর্ট, অন্যদের শেখানোর যোগ্য হয়ে উঠেছে৷ বাকি বিশ্বও যাতে সেগা আবিষ্কার করে, সেটাই আমার লক্ষ্য৷ কারণ মরিশাসে অনেক প্রতিভাবান শিল্পী রয়েছেন৷ প্রতিদিন, প্রতি রাতে আমি যখন বিদেশি পর্যটকদের সামনে সেগা পরিবেশন করি, তখন তাদের সেগা, মারাভান, ট্রায়াংগেল, গিটারের তাল ও ধ্বনিতে আচ্ছন্ন হতে দেখে অসাধারণ লাগে৷ সেটা খুবই শক্তিশালী৷ কত মানুষের হৃদয়ে আনন্দ দিতে পারে৷ সেগা হতে দাও৷ ভিভা মোরিস, ভিভা সেগা৷''

সেগা স্পিরিটের প্রতিমূর্তি হিসেবে লা নিকিতা মরিশাসের হৃদস্পন্দন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখার নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷

ইনগ্রিড বেল/এসবি