1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়লেও জিনিসের দাম বাড়ে না

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
৯ জুন ২০২৩

ভারতের জিনিসের দাম বাড়া-কমার সঙ্গে সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়া-কমার বিশেষ যোগ নেই৷

https://p.dw.com/p/4SMln
ভারতীয় রুপি৷
ভারতের জিনিসের দাম বাড়া-কমার সঙ্গে সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়া-কমার বিশেষ যোগ নেই৷ছবি: Indranil Mukherjee/AFP/Getty Images

১৪২ কোটির দেশে কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে সরকারি কর্মীর সংখ্যা তিন কোটির মতো (সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক, অধ্যাপকদের ধরে)৷ সংখ্যার হিসাবে তারা নগন্য৷

এখানেই শেষ নয়, ১৪ লাখ সেনা-সহ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীর সংখ্যা ৪৮ লাখ৷ এর মধ্যে যারা খুব বেশি মাইনে পান, সেই উচ্চপদস্থ আমলাদের সংখ্যা দুই দশমিক আট শতাংশ মাত্র৷ তাদের বলা হয় গ্রুপ এ কর্মী৷ আর নিচের তলার কর্মী, যাদের গ্রুপ সি ও ডি বলা হয়, তাদের সংখ্যা প্রায় ৮৯ শতাংশ৷ তাদের বেতনের সঙ্গে ছোট বা বড় আমলার বেতনের কোনো তুলনাই চলে না৷ সপ্তম বেতন কমিশনের সুপারিশ মেনে এখন কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ন্যূনতম বেতন হলো ১৮ হাজার টাকা৷ আর আইএএসেরন (ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিসস্ট্রেটিভ সার্ভিস) সচিব পর্যায়ের অফিসারদের বেতন মাসে আড়াই লাখ টাকা৷ তার সঙ্গে অবশ্য সরকারি গাড়ি-বাড়ি-সহ কিছু সুযোগ সুবিধা আছে৷

এর পাশাপাশি অন্যদিকের ছবিটা দেখুন৷ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্য়ানেজমেন্ট (আইআইএম) এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজি (আইআইটি) পাস করে যারা বেরোচ্ছে, তাদের অনেকে চাকরিজীবন শুরুই করছে বছরে এক কোটি টাকার বেতন দিয়ে৷ একদিন আগেই আইআইটি চেন্নাইয়ের প্রধান হাসিমুখে টিভি-তে সাক্ষাৎকার দিয়ে জানাচ্ছিলেন, তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এবার ২৫ জন ছাত্রছাত্রী বছরে এক কোটি টাকা বেতন নিয়ে বিভিন্ন সংস্থায় ঢুকছে৷ সব আইআইটি মিলিয়ে প্রতিবছর প্রচুর ছাত্রছাত্রী বছরে এক কোটি টাকার বেশি প্যাকেজ নিয়ে চাকরিজীবন শুরু করছে৷ ক্যাবিনেট সচিব ও বিভিন্ন দপ্তরের সচিবরা চাকরি জীবনের শেষে এসে যে অর্থ পাচ্ছেন, তার থেকে চারগুণ অর্থ নিয়ে এই ছাত্রছাত্রীরা চাকরিজীবন শুরু করছে৷

দিল্লির ভালো ভালো কলেজ থেকে অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হওয়ার পরই ছেলেমেয়েরা রাশি রাশি বেতন পাচ্ছে৷ লেডি শ্রীরাম কলেজ থেকে বছরে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা বেতন নিয়ে চাকরিতে ঢোকা কোনো ব্যাপার নয়৷  যে কোনো বিষয়ে স্নাতক হওয়ার পর ভালো কলেজগুলি থেকে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে ১২ থেকো ২০ লাখ টাকার প্যাকেজ নিয়ে চাকরিতে যোগ দিচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা৷ আইটি, অর্থলগ্নি সংস্থা, বিপিও, বড় কর্পোরেট, বহুজাতিক সংস্থা এমনকী স্টার্ট আপ, ব্যাংকের মতো বিভিন্ন সংস্থা তাদের কর্মীদের সরকারের তুলনায় অনেক বেশি বেতন দেয়৷ এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটু সিনিয়র পর্যায়ের অধ্যাপকেরা মাসে আড়াই লাখ টাকা করে পাচ্ছেন৷ ফলে একটা সময় সরকারি চাকরি নিয়ে যে উন্মাদনাটা ছিল, তা আর এখন নেই৷ কারণ, সরকারি চাকরির থেকে অনেক বেশি টাকা পাওয়া যাচ্ছে বেসরকারি কোম্পানিতে৷

ভারতে আবার যখন তখন সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়ে না৷ প্রতি দশ বছর পর পর বেতন কমিশন গঠন করার কথা৷ তাদের সুপরিশ অনুসারে সরকারি কর্মীদের বেতন বাড়ার কথা৷ সপ্তম বেতন কমিশন সরকারি কর্মীদের বেতন অনেকখানি বাড়িয়েছিল৷ আর সেই টাকা দিতে গিয়ে প্রবল অসুবিধায় পড়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার৷ অধিকাংশ রাজ্য সরকার তো তারপর আর নিয়মিত ডিএ দিতে পারে না৷ পশ্চিমবঙ্গে ডিএ-র দাবিতে সরকারি কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে নেমেছেন৷ সপ্তম বেতন কমিশন গঠিত হয় ২০১৪ সালে, তাদের  রিপোর্ট কার্যকর হয়েছিল ২০১৬ সালে৷ এখন আবার অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার সেই দাবিতে এখনো পর্যন্ত কান দেয়নি৷ কোনো রাজ্য সরকারই এতে আগ্রহী নয়৷ কারণ, প্রতিটি রাজ্য সরকার আর্থিক সংকটে আছে৷ তারা আর বোঝা বাড়াতে চায় না৷ তাই প্রতিবছর যতজন সরকারি কর্মী অবসর নিচ্ছেন, ততগুলি পদ ভর্তি করা হচ্ছে না৷ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মিলিয়ে লাখ লাখ পদ খালি৷ কিন্তু সরকার সমানে কর্মী তকমাতে চাইছে৷

এমনিতে সরকারি কর্মীদের প্রতি বছর তিন শতাংশ হারে বেতন বাড়ে৷ সেই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতির হারের সঙ্গে মানানসই ডিএ বাড়ার কথা৷ সেটাও বছরে দুই বার৷  কিন্তু কেন্দ্র সেই ডিএ দিলেও পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্য সরকার সেই ডিএ দিতে পারে না৷ জনমোহিনী নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে জিতে আসার পর তা পূরণ করতে গিয়ে হাতে টাকা থাকে না৷

ফলে জিনিসের দামের সঙ্গে সরকারি কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির খুব যে সম্পর্ক আছে তা বলা যাবে না৷ তবে ছোটবেলায় দেখেছি, দুর্গাপুরের মতো শিল্পশহরে কর্মীরা দুর্গাপুজোর বোনাস পেলেই জিনিসের দাম বাড়ত৷ কারণ, ওই শহরে তখন ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ছিলেন সরকারি ও আধা সরকারি কর্মী৷  রেলশহরগুলিতেও একই ঘটনা ঘটত৷ কিন্তু ৯১-র পর থেকে ভারত যখন উদার অর্থনীতির পথে হেঁটেছে, তখন থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে গেছে৷  এখন তো ওই সব শহরের চাল-চরিত্র-চেহারা পুরো বদলে গেছে৷

এখন বরং ভারতের বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে জিনিসের দাম বাড়ে৷ পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়লে বাড়ে, ভোটের আগে ও পরে দাম বাড়ে৷ নিন্দুকরা বলেন, দাম না বাড়লে হাজার হাজার কোটি টাকার ভোটপ্রচারের খরচ কে দেবে? কিছু ব্যবসায় কোনো শিল্পপতির একচেটিয়া দখলদারি থাকলে বাড়ে৷ কিছুদিন আগে সর্ষের তেলের দাম লিটারপ্রতি দুইশ টাকার বেশি হয়ে গিয়েছিল৷ এখন আবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২০ টাকা৷ ওই ওঠাপড়ার সঙ্গে কীসের সম্পর্ক আছে, কোনো বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীর সম্পর্ক আছে কি না, তা অর্থনীতির ছাত্ররা অনেক ভেবেও বের করতে পারে না৷ মাংস কেন ৭০০ টাকা কিলোয় বিক্রি হয়, ইলিশ মাছ কেন দেড় হাজার টাকা কিলো দরে বিক্রি হয়, কারা কেনে, কেন কেনে--এসব প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর সাধারণ মানুষের সামনে নেই৷ চাহিদা-যোগানের তত্ব এখানে অনেকসময়ই খাটে না৷ কাটা রুইয়ের কিলো ৫০০ টাকা করে, ছাল ছাড়ানো মুরগি ২২০ টাকা করে, বড় চিংড়ি ৬০০ টাকা করে, ছোট হলে ৪০০ টাকা, সেখানে একটা ইলিশ কিনতে প্রায় আড়াই হাজার টাকার ধাক্কা৷ তাও তো বাজারে একটা ইলিশও পড়ে থাকে না৷ কারণ, কিছু মানষের কেনার ক্ষমতা এতটাই বেড়ে গেছে যে সপ্তাহে এক বা একাধিক ইলিশ তারা অনায়াসে কিনে নিয়ে যান৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

এমনকী আইনজীবী, চিকিৎসক, অধ্যাপক, আইটি, বিপিও, শিক্ষক, কর্পোরেট, বহুজাতিক সংস্থার কর্মীদের খরচ করার ক্ষমতা বেড়েছে৷ ব্যবসা ও শিল্প করে প্রচুর মানুষ ভালো টাকা রোজগার করছেন৷  দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়া, দামি জিনিস কেনার দিকে মানষের ঝোঁক অনেক বেড়েছে৷ দিল্লিতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের হাতে লেটেস্ট মডেলের আইফোন ঘোরে৷ শুক্রবার রাত থেকে রোববার রাত পর্যন্ত দিল্লি ও গুড়গাওতে ভালো রেস্তোরাঁয় জায়গা পাওয়া যায় না৷ লাইন দিতে হয়৷ এই রেস্তোরাঁ এখন কাতারে কাতারে আছে৷ দুইজনের রাতের খাবার অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা৷ তাও সেখানে জায়গা মেলে না৷

কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব ও দিল্লির রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ বা তার বেশি আসে মদের উপর বসানো শুল্ক থেকে৷ ভারতের সব রাজ্যের গড় ধরলে রাজ্য যদি সাত টাকা আয় করে, তার মধ্যে এক টাকা আসছে মদের উপরে শুল্ক থেকে৷ এর থেকে একটা ছবি স্পষ্ট, মদের পিছনে কত টাকা খরচ করছেন ভারতের মানুষ৷ এ তো গরিব মানুষের চুল্লু, ধেনোর মতো দিশি মদ নয়, দামি বিলিতি মদ থেকে এই টাকাটা আসছে৷ সেটা খরচ করার মতো ক্ষমতা মানুষের হয়েছে৷ তাই আড়াই কোটি সরকারি কর্মী যা খরচ করবেন, তার থেকে অনেক বেশি খরচ করবেন প্রায় ৪৫ কোটির মতো মধ্যবিত্ত মানুষ৷

সন্দেহ নেই, সরকারি কর্মীদের বেতন আগের থেকে ভালো হয়েছে, কিন্তু তাদের বেতন বাড়লে বাজারে জিনিসের দাম বাড়ে না৷ কারণ, তারা এখন নেহাতই সংখ্যালঘু৷ বরং বেসরকারি সংস্থার রমরমা৷ তারাই বাজারকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে৷