1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিদ্যুৎ সহসা সুখবর নেই, শিল্পে কমছে উৎপাদন, বাড়ছে খরচ

সমীর কুমার দে ঢাকা
৬ জুন ২০২৩

লোডশেডিং ভয়াবহ রূপ নিয়েছে বাংলাদেশে৷ তীব্র তাপদাহের সঙ্গে লোডশেডিংয়ে জনজীবন অস্থির হয়ে উঠেছে৷

https://p.dw.com/p/4SGDi
ফাইল ফটো
ফাইল ফটোছবি: Mahmud Hossain Opu/AP Photo/picture alliance

খোদ রাজধানী ঢাকাতেই এখন লোডশেডিং হচ্ছে ৫ থেকে ৭ ঘন্টা৷ গ্রামে সেটা কোন কোন দিন ১০ ঘন্টাও পার হয়ে যাচ্ছে৷ বৃষ্টি ছাড়া আপাতত কোন সমাধান নেই বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে৷ অন্তত ২০ দিনের মধ্যে সমাধানের কোন আশ্বাসও দিতে পারছেন না নীতিনির্ধারকেরা৷ এমন পরিস্থিতিতে শিল্পে উৎপাদন কমে যাচ্ছে৷ বাড়ছে খরচ৷  

বিদ্যুতের এই খারাপ সময়ের মধ্যে বন্ধ হয়েছে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র৷ এর ফলে বন্ধ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউনিটের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫৭টিতে৷ অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকেরও নিচে নামলো গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ সক্ষমতা৷ বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো৷ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত রবিবার রাত ১টায় সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেড হয়৷ ওই সময় ১৪ হাজার ৩০৮ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ আমদানি এবং উৎপাদিত হয় ১১ হাজার ২৮৪ মেগাওয়াট৷ এ দিন সবচেয়ে কম সকাল ৭টায় ১১ হাজার ১৩৪ মেগাওয়াট এবং সবচেয়ে বেশি রাত ৯টায় ১৩ হাজার ৭৮১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়৷  বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকৌশলীরা জানান, দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় গত ১৯ এপ্রিলে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট৷ বর্তমানে যে গরম তাতে জ্বালানি সরবরাহ গেলে ১৭ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেত উৎপাদন৷ সে বিবেচনায় লোডশেডিং প্রকৃতপক্ষে ৫ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি৷

বর্তমানে আমদানিসহ দৈনিক ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে চালু থাকা ১৪৯টি কেন্দ্রের৷ রক্ষণাবেক্ষনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ রয়েছে চারটি কেন্দ্র, যেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা আরো ৩০৯ মেগাওয়াট৷ এখন এক তৃতীয়াংশের বেশি কেন্দ্র বন্ধ এবং উৎপাদন ক্ষমতা অর্ধেকের নিচে নেমেছে৷ এখন গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট৷ এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানিকৃত দৈনিক এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎও রয়েছে৷

‘লোডশেডিংয়ের কারণে এখন জেনারেটরের উপর ভরসা করতে হচ্ছে’

বাংলাদেশ ন্যাশনাল পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার কারণে যে ৬০০-৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমরা এখন কম পাব সেটা অন্যভাবে পুষিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ আদানি থেকে এখন যে বিদ্যুৎ আসছে সেটা কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে৷ পাশাপাশি রামপালেরও উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে৷ ফলে এই ঘাটতি আপাতত পূরণ করা সম্ভব হবে৷ তবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরতে ২৩ জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ ইতিমধ্যে কয়লা আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে৷ ১২ জুন ইন্দোনেশিয়া থেকে ৬০ হাজার টন কয়লা আসছে৷ ২৩ জুন সেটা পৌঁছবে৷ এরপর আবার চালু হবে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র৷ ফলে সেই পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে৷”

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১২ জুন জাহাজ রওনা দিলেও ইন্দোনেশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসতে অন্তত ১৫ দিন লাগবে৷ অর্থাৎ ২৭ জুনের আগে সেই কয়লা পৌঁছবে না৷ জাহাজ থেকে কয়লা নামানোর পর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করতে ২৯-৩০ জুন হয়ে যাবে৷ এর মধ্যে সরকার ভারতের আলোচিত-সমালোচিত শিল্প গ্রুপ আদানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে৷ আদানি থেকে বর্তমানে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে৷ এখন সেটা বাড়িয়ে এক হাজার ৫০ মেগাওয়াট আনার চেষ্টা হচ্ছে৷ পাশাপাশি রামপালের উৎপাদনও কিছুটা বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে৷ আবার শিল্পে কিছুটা গ্যাস কমিয়ে বিদ্যুতে দেওয়ার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে৷

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন যদি আমরা ঋণপত্র খুলতে পারি, তাহলে ২০ দিন আগে সেটা কেন করিনি? অর্থাৎ আমাদের পরিকল্পনায়ও ঘাটতি আছে৷ ডলার সংকট তো আছেই? কিন্তু সেই সংকট এতটা না যে, আমরা কয়লা কিনতে পারব না৷ এখন তো আর ডলার উড়ে আসছে না৷ পরিকল্পনা করে যদি কয়েকদিন আগে ঋণপত্র খোলা যেত, তাহলে কিন্তু সাধারণ মানুষকে এত কষ্ট পেতে হতো না৷ তার চেয়েও বড় কথা হল, আমরা শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করেছি, কিন্তু জ্বলানির দিকে মনোযোগ দেইনি৷ পরনির্ভরশীল হয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালাতে চেয়েছি৷ সেটা তো কোন সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না৷ আমাদের উচিৎ ছিল জ্বালানির দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া৷ সরকার সেটা করেনি৷ এখন তার ফল পেতে হচ্ছে৷”

এখন যদি শিল্পে কমিয়ে বিদ্যুতে গ্যাস বাড়ানো হয় তাহলে শিল্প উৎপাদনে ভয়াবহ ধস নামবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "বিদ্যুতের লোডশেডিং আর গ্যাস সংকটের কারণে এমনিতেই আমরা মহাসংকটে আছি৷ এরপর যদি গ্যাস কমিয়ে দেওয়া হয় তাহলে রপ্তানিতে ধস নামবে৷ আমাদের নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়া হবে এই শর্তে গত ফেব্রুয়ারিতে আমরা গ্যাসের প্রতি ইউনিটের দাম ১১ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা দিতে রাজি হয়েছি৷ এখন দামও বাড়ানো হল, গ্যাসও পাচ্ছি না৷ জেনারেটর দিয়ে ফ্যাক্টরি চালাতে গিয়ে উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে৷” 

গাজীপুরের পুবাইল ও নরসিংদী বিসিকে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় হস্তশিল্প রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের দু'টি কারখানা রয়েছে৷ বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় কারখানা দু'টিতে ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালাতে হচ্ছে দিনের একটি বড় সময়ে৷ আবার সব যন্ত্র জেনারেটরে চালানো যায় না৷ তাই উৎপাদন ঠিক রাখতে কর্মীদের দিয়ে তিন-চার ঘণ্টা ওভারটাইম করানো হচ্ছে৷ তাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে ১০-১৫ শতাংশ৷

প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করিম মুন্না ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রোববার আমার পুবাইলের কারখানায় সাত থেকে আটবার লোডশেডিং হয়েছে৷ আর নরসংদীর কারখানায় পাঁচ থেকে ছয়বার৷ অবস্থা এমন যে আমরা বসে থাকি, কখন বিদ্যুৎ আসবে৷ সামনের দিনে বিদ্যুতের অবস্থার আরও অবনতি হলে লোকসান ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না৷ বর্তমানে এলাকা ভাগ করে কোন এলাকায় কখন বিদ্যুৎ থাকবে না, সেটি পরিষ্কার করে আগে থেকেই সবাইকে জানানো প্রয়োজন৷ তাহলে আমরা সেইভাবে প্রস্তুতি রাখতে পারি৷”

গ্যাস সংকটের পাশাপাশি লাগামছাড়া লোডশেডিংয়ে গার্মেন্টস কারখানার উৎপাদনও কমছে৷ রপ্তানি পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্থ, বিদেশি ক্রেতা হারানো ও বায়ারদের কাছে জরিমানার আশঙ্কা করছেন গার্মেন্টস মালিকরা৷ লোডশেডিংয়ের সময় যারা নিজস্ব জেনারেটরে কারখানা চালাচ্ছেন, তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে অনেক৷ অনেক কারখানার শ্রমিকরা দিনের বড় অংশ অলস সময় কাটাচ্ছেন৷ বিদ্যুতের ঘন ঘন যাওয়া-আসার কারণে কারখানার যন্ত্রপাতিও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে৷ নষ্ট হচ্ছে শিল্পের কাঁচামাল৷ কমেছে শ্রমিকদের আয়৷

লোডশেডিংয়ে গার্মেন্ট শিল্পে কী প্রভাব পড়ছে? জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন তো আমাদের অর্ডার এমনিতেই কম৷ তার মধ্যে লোডশেডিংয়ের কারণে আমাদের জেনারেটরের উপর ভরসা করতে হচ্ছে৷ সেখানে তেল কিনতে বিপুল অংকের টাকা খরচ হচ্ছে৷ আবার শ্রমিকদের দিয়ে ওভারটাইম করাতে গিয়ে তাদের অতিরিক্ত টাকা দিতে হচ্ছে৷ এতে উৎপাদন খরচ অন্তত ৩৫ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু আমরা তো বায়ারদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিতে পারছি না৷ ফলে লোকসান হওয়া ছাড়া কোন পথ নেই৷ তারপরও লাভ লোকসান না দেখে নির্ধারিত সময়ে শিপমেন্টের দিকেই আমরা মনোযোগ দিচ্ছি৷ কিন্তু এভাবে দীর্ঘদিন চললে রপ্তানিতে অবশ্যই ধস নামবে৷”