1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
স্বাস্থ্যবাংলাদেশ

ডেঙ্গু দৃশ্যমান সমস্যা, যা মোকাবেলা কঠিন নয়

ড. কবিরুল বাশার
১২ মে ২০২৩

স্বাধীন বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখা গিয়েছিল৷ ওই বছর সরকারি হিসাবে পাঁচ হাজার ৫০০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ মারা গিয়েছিলেন ৯৩ জন৷

https://p.dw.com/p/4RFqG
এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে (ফাইল ছবি)
এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে (ফাইল ছবি)ছবি: Mortuza Rashed/DW

তবে বাংলাদেশে ডেঙ্গু সবচাইতে বড় আঘাত হানে ২০১৯ সালে৷ ঐবছর এক লাখ এক হাজার তিনশ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন৷ বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছিল৷

এক সময় ডেঙ্গু ঢাকার রোগ ছিল৷ কিন্তু এখন এটি বিস্তৃত হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে৷ মে মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গু ঊর্ধ্বমুখী৷

মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ বছর চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে অন্যান্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু বেশি হওয়ার ঝুঁকি আছে৷ ঢাকাতেও ডেঙ্গুর দাপট থাকবে৷

করোনার মতো ডেঙ্গু অদৃশ্য শক্তি নয়৷ ডেঙ্গু একটি দৃশ্যমান শক্তি, যাকে মোকাবেলা করা খুব কঠিন নয়৷ 

ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে৷ এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷

অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণও সহজ, কারণ এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে বংশবিস্তার করে৷ জমা পানির পাত্র অপসারণ কঠিন কোনো কাজ নয়৷

এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে৷ অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশা কীটনাশক সহনশীল, তাই কীটনাশক দিয়েও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ৷ 

যে পদক্ষেপগুলো নেয়া জরুরি

  • যেসব এলাকা ডেঙ্গুর হটস্পট হয়ে গেছে অর্থাৎ আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি, সেইসব এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে অন্য ওয়ার্ড থেকে ফগিং মেশিন সরবরাহ করে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে উড়ন্ত মশা মারার অভিযান পরিচালনা করতে হবে৷
  • অন্য ওয়ার্ডগুলোর ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ডকে দশটি ব্লকে ভাগ করে দশটি টিম গঠন করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন৷ এই দশ টিমের প্রতিটিতে স্থানীয় তরুণ সমাজ সেবকদের দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন কর্মীদেরকে যুক্ত করে দিয়ে এডিস মশার প্রজনন পাত্র ধ্বংস ও অপসারণের পাশাপাশি উড়ন্ত মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে৷ প্রতিটি টিমকে নিশ্চিত করতে হবে যেন তার ব্লকে কোনো এডিস মশা জন্মানোর পাত্র না থাকে৷ প্রতিটি ব্লকের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মনিটরিং ও ইভালুয়েশনের জন্য সিটি কর্পোরেশনের সেন্ট্রাল টিম থাকতে পারে৷ যে ব্লকে ডেঙ্গু রোগী সবচেয়ে কম হবে তাদেরকে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে কাজে উৎসাহিত করা যেতে পারে৷ 

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা

অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়৷ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে পাঁচ থেকে দশ বছর মেয়াদী মহাপরিকল্পনা৷ এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সারাবছরব্যাপী চলমান থাকতে হবে৷ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের মহাপরিকল্পনায় সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা বা ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্ট বাস্তবায়ন করতে হবে৷ সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি মূল পিলারকে একসাথে সারাবছর বাস্তবায়ন করতে পারলেই এডিস মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জিকাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷

সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার চারটি পিলার-

১. পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ: পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যার কারণে মশার জন্ম হয়৷ পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মশার প্রজননস্থল কমানো এবং ধ্বংস করে মশাকে সহজভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ উদাহরণস্বরূপ জলাধার পরিষ্কার এবং বিভিন্ন পানির পাত্র অপসারণ ও পরিষ্কার রাখা৷

২. জীবজ নিয়ন্ত্রণ: উপকারী প্রাণীর মাধ্যমে মশাকে নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি পৃথিবীতে প্রচলিত আছে৷ যেমন গাপ্পি মাছের মাধ্যমে পরিবেশগতভাবে অল্প খরচে টেকসই উপায় মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব৷ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কপিপোড এবং এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহারও পৃথিবীতে প্রচলিত আছে৷ এজাতীয় জীবজ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন৷

ড. কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক
ড. কবিরুল বাশার, কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপকছবি: private

৩. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ: মশা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইড এবং এডাল্টিসাইড কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ প্রতিটি কীটনাশকের একটি নির্দিষ্ট ডোজ এবং কতদিন পর পর কোন মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে তারও একটি নির্দেশনা রয়েছে৷ নির্দেশনা অনুযায়ী বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে কীটনাশকের ব্যবহার করলে অবশ্যই মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব৷

৪. মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ: জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়া দুষ্কর৷ তাই এ প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে৷ বিশেষ করে সামাজিক সংগঠনগুলোকে উদ্বুদ্ধ করে একাজ করানো যেতে পারে৷ জুন, জুলাই, আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর- এই চার মাস ডেঙ্গুর মৌসুম৷ এ সময়টায় যদি সতর্ক থাকলে ডেঙ্গু থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব৷

ডেঙ্গু এমন এক সমস্যা যেটিকে সরকার বা সিটি কর্পোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না৷ পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি৷ তাই জনসাধারণকে এ কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে৷

  • এডিস মশার জন্ম হয় পাত্রের জমে থাকা পানিতে৷ সপ্তাহে অন্তত একদিন নিজ নিজ বাড়ি এবং বাড়ির চারদিকে ঘুরে দেখতে হবে কোথাও কোনো পাত্রে পানি জমে আছে কি না৷ যদি থাকে তাহলে তা ফেলে দিতে হবে৷
  • যদি পাত্রটি এমন হয় যে পানি ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না তাহলে সেখানে কীটনাশক বা কেরোসিন বা ব্লিচিং পাউডার বা লবণ দিতে হবে৷ গাড়ির অব্যবহৃত টায়ার বাসায় না রাখা ভালো, কারণ সেখানে এডিস মশার জন্ম হয়৷ যদি রাখতেই হয় তাহলে ছাউনির নিচে রাখতে হবে যেন পানি জমা না হয়৷
  • দই বা যে-কোনো খাবারের পাত্র বাহিরে ফেলবেন না৷
  • বাথরুমে যদি পানি ধরে রাখতে হয় তাহলে পানির পাত্র সপ্তাহে অন্তত একবার ব্লিচিং পাউডার বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালো করে ধুয়ে আবার পানি ভর্তি করতে হবে৷ এডিস মশা পানির পাত্রের কিনারে ডিম পাড়ে এবং পাত্রের গায়ে আটকে থাকে৷  যে কারণে পানি ফেলে দিলেও ডিম নস্ট হয় না৷ তাই একে ব্লিচিং পাউডার বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভালোভাবে ঘষে পরিষ্কার করা প্রয়োজন৷
  • বাড়ির পাশে কোনো নির্মাণাধীন ভবন থাকলে তার বেজমেন্ট, লিফটের গর্ত, ইট ভেজানোর চৌবাচ্চা, ড্রাম পরীক্ষা করে দেখতে হবে৷ যদি এসব জায়গায় জমে থাকা পানিতে ছোট ছোট পোকা দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে সেটি এডিস মশার লার্ভা বা বাচ্চা৷ নির্মাণাধীন ভবনের মালিককে সামাজিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতে হবে যেন সে তার বাড়িতে মশা জন্মানোর স্থান তৈরি না করেন৷
  • নির্মাণাধীন ভবনটি যদি আপনার হয় তাহলে সেখানে জমে থাকা পানিতে কীটনাশক বা কেরোসিন বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে রাখুন৷ আপনার বাড়ির আশেপাশে যদি মশা জন্মানোর মতো কোনো সরকারি বেসরকারি স্থাপনা থাকে তাহলে ওই অফিসকে জানান৷
  • বাড়ির আশেপাশে গাছের গর্ত বা কাটা বাঁশের গোড়া মাটি দিয়ে বন্ধ করে দিন৷ কারণ গাছের কোটর বা বাশের গর্তে এডিস মশার জন্ম হয়৷

আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন

 পৃথিবীতে কোনো নাগরিকের সম্পৃক্ততা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ করা কখনোই সম্ভব নয়৷ নাগরিকদেরকে মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করার জন্য পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে আইন রয়েছে৷ সেরকম একটি আইন বাংলাদেশে তৈরি করে তার বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন৷ কোনো ব্যক্তি যেন তার নিজ জায়গায় মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে অপরের ক্ষতি করতে না পারে, তা রোধ করাই এই আইনের উদ্দেশ্য৷

মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশকের পর্যাপ্ততা

মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত কীটনাশক জনগণের হাতের নাগালে আনতে হবে৷ তেলাপোকা এবং ইদুর মারার কীটনাশকের মতো মশা নিয়ন্ত্রণের কীটনাশক মানুষের কাছে সহজলভ্য হতে হবে যেন মানুষ সহজেই এ কীটনাশক কিনে তার বাড়ি এবং আশেপাশে ব্যবহার করতে পারে৷

কীটনাশক রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজ করা

একটি কীটনাশক বাজারজাত করতে গেলে যে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া রয়েছে সেটিতে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়৷ একটি কীটনাশক রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করার পরে সর্বোচ্চ তিন মাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রয়োজন৷

ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কাউকে দোষারোপ না করে যার যার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন৷ সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থান, সরকারি স্থাপনা, বাস টার্মিনালগুলোতে এডিস মশার প্রজনন বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা, আর নগরবাসীর দায়িত্ব তার বাড়ি এবং আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয় তা নিশ্চিত করা৷ 

সিটি করপোরেশন ও নগরবাসীর সম্মিলিত কার্যক্রমই পারে ডেঙ্গু সমস্যার সমাধান করতে৷

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য