জায়েদা খাতুনের জয়ে জাহাঙ্গীর ও আটটি বিষয়ের ভূমিকা
২৬ মে ২০২৩নির্বাচন সুষ্ঠু হলে যে জায়েদা খাতুন জয়ী হবেন- এ বিষয়ে তাদের অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন৷ আর সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ায় সেই ফলই এসেছে৷ তবে জায়েদা খাতুনকে নয়, ভোটাররা আসলে পরোক্ষভাবে ভোট দিয়েছেন গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে৷
জাহাঙ্গীর আলম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত হন৷ তাকে মেয়র পদ থেকে সাসপেন্ড করা হয়৷ নির্বাচনের আগে দলে ফিরিয়ে নেয়া হলেও তাকে মনোনয়ন না দেয়ায় তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হন৷ তখন তাকে দল থেকে আবার স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়৷ কিন্তু ঋণখেলাপী হওয়ার কারণে তার প্রার্থীতা বাতিল করা হয়৷ জাহাঙ্গীর হয়তো প্রার্থিতা যে বাতিল হবে তা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন৷ তাই তার মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থী করেন এবং তার প্রার্থীতা টিকে যায়৷ শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে হারিয়ে তিনিই এখন গাজীপুরের মেয়র৷
গাজীপুরের বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয় এবং জাঙ্গীরের মায়ের জয় সম্পর্কে নানা ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে৷ তারা বলছেন:
১. আওয়ামী লীগ জাহঙ্গীরকে বহিস্কার করলেও গাজীপুরের তৃণমুলে তার অবস্থান কখনোই দুর্বল হয়নি৷ তার তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ সব সময়ই ছিল৷ গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকা কালেই তিনি তার এই শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন৷
২. আজমত উল্লা খান মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও প্রথম সিটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর থেকে তৃণমূলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না৷ তাছাড়া তিনি মহানগরের আট থানায় যে কমিটি দিয়েছেন, তা ‘পকেট কমিটি' নামে পরিচিত৷ তৃণমূলের সাথে তাদেরও যোগাযোগ নেই৷
৩. এবার মনোনয়নের ব্যাপারেও আজমত উল্লা নিশ্চিত ছিলেন না৷ ফলে তার প্রস্তুতিও তেমন ছিল না৷ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই জাহাঙ্গীরের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করায় অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি মনোনয়ন পাবেন৷ জাহাঙ্গীরও প্রস্তুত ছিলেন৷
৪. গাজীপুর আওয়ামী লীগ তিন ধারায় বিভক্ত৷ আজমত উল্লা তার একটি ধারার নেতৃত্ব দেন৷ জাহাঙ্গীর কোনো ধারার সাথে না থেকে আজমতবিরোধী ধারাগুলোর সমর্থন নেন৷
৫. জাহাঙ্গীর এক প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতার আশীর্বাদপুষ্ট৷ এর আগে ওই নেতাই জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদে মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছিলেন৷ দল থেকে জাহাঙ্গীর বহিস্কার হলেও ওই নেতার আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হননি তিনি৷
৬. বিএনপির মেয়র পদে প্রার্থী না থাকায় নির্বাচনের খেলা জাহাঙ্গীরের পক্ষে চলে যায়৷ বিএনপির ভোটও তার মায়ের দিকে আসে৷
৭. জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়া, নির্বাচনের আগে দুদকের তৎপরতা, গাড়িতে হামলা- সব মিলিয়ে তার ওপর সরকারে চাপ তাকে ভোটারদের সহানুভূতি পেতে সহায়তা করে৷ এর সুফল পেয়েছেন তার মা৷
৮. আওয়ামী লীগ ছাড়াও অন্যসব দলের নেতাদের সঙ্গে জাহাঙ্গীর সুসম্পর্ক রেখে চলেন৷
জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন তার এত জনপ্রিয়তা- এই প্রশ্নের জবাবে কেউ কেউ বলেছেন দুর্নীতি করে থাকলেও সাবেক মেয়র তাদের পাশে দাঁড়ান আর সে কারণে সাধারণ মানুষও তার পাশে থাকে৷
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ওসমান আলীর সঙ্গে৷ তিনি বলেন, ‘‘গাজীপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ জাহাঙ্গীরের মায়ের জন্য কাজ করেছে৷ তারা আসলে জাহাঙ্গীর দল থেকে বহিস্কার হলেও জাহাঙ্গীরের সঙ্গ কখনো ত্যাগ করেনি৷ এরকম নেতাদের চিহ্নিত করে আগে আমরা বহিস্কারের সুপারিশ করলেও তাদের বহিস্কার করা হয়নি৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘জাহাঙ্গীরের মা আওয়ামী লীগের অনেক ভোট পেয়েছেন৷ এছাড়া জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতসহ আরো অনেক রাজনৈতিক দলের যোগাযোগ আছে৷ সব সময়ই সে এই যোগাযোগ রাখতো৷ তাদের দিক থেকেও ভোট পেয়ছে৷’’
তার কথা, ‘‘আজমত উল্লা খান একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ৷ তিনি সার্বক্ষণিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত৷ তিনি হেরে যাওয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি৷ মহানগরের নেতারা আমরা তার সঙ্গেই ছিলাম৷ কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়৷ জাহাঙ্গীরের অনেক টাকা৷ ঢাকার কাছে অনেকে বিক্রি হয়ে গেছেন৷’’
আর গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাছান উদ্দিন সরকার বলেন, ‘‘যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে দাঁড়াবে সে-ই পাস করবে৷ গাজীপুরে তাই হয়েছে৷ জায়েদা খাতুন আগে রাজনীতি করেননি৷ তার কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই৷ তার পরিচয় তিনি আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত নেতা জাহাঙ্গীর আলমের মা৷ আয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে তাকেই ভোট দিয়েছেন ভোটাররা৷’’
তার কথা, ‘‘বিএনপি যেহেতু নির্বাচনে নেই, আমাদের মেয়র প্রার্থী নেই, তাই জাহাঙ্গীরের মা-কে ভোটাররা ভোট দিয়েছেন৷ আমরা নির্বাচন করলে ভোটারর আমাদের প্রার্থীকেই ভোট দিতেন৷ সেই সুযোগ না পেয়ে তারা আজমত উল্লা ও আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে৷ এখানে আরেকটি কথা বলি৷ আজমত উল্লাকে গাজীপুরের লোকরা পছন্দ করেন না৷ আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাছাইয়েও ভুল করেছে৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘জাহঙ্গীরের মা-কে আওয়ামী লীগের লোকজনই ভোট দিয়েছেন৷ কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য বিএনপির কিছু ভোটার ভোট কেন্দ্রে গেছেন৷ তারা আজমত উল্লাকে ভোট দেয়নি৷’’
স্থানীয় সূত্র জানায়, এবার কাউন্সিলর প্রার্থীরা মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননি৷ তারা তাদের জয়ের কথা চিন্তা করেই কাজ করেছেন৷ আওয়ামী লীগের যারা কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন তারা মেয়র পদে আজমত উল্লার জন্য কাজ করেননি৷ এটাও জাহাঙ্গীরের মায়ের পক্ষে গেছে৷