1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঈদ কার্ডে পাঠানো ভালোবাসার বার্তা ফিরে আসুক

শামীমা নাসরিন
১২ এপ্রিল ২০২৪

বছর ঘুরে চলে গেল আরেকটি ঈদ৷ নতুন জামা-জুতো, ফিরনি-সেমাইয়ের সঙ্গে এক সময় ঈদের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছিল ঈদ কার্ড৷

https://p.dw.com/p/4egS2
গ্রিটিংস কার্ড
আশি-নব্বইয়ের দশকে তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে কিশোর বয়সি এমনকি স্কুল পড়ুয়া শিশুদের মাঝেও ঈদ কার্ড বিনিময় করা নিয়ে ছিল উত্তেজনা আর আবেগছবি: photothek/picture alliance

তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে কিশোর বয়সি এমনকি স্কুল পড়ুয়া শিশুদের মাঝেও ঈদ কার্ড বিনিময় করা নিয়ে ছিল সেকি উত্তেজনা আর আবেগ৷

বলছি সেই গত শতাব্দীর আশি-নব্বইয়ের দশকের কথা৷ প্রযুক্তি তখনও এতটা বিস্তার লাভ করেনি৷ মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া কিছুই তখন ছিল না৷ ছিল শুধু ল্যান্ড ফোন, তা-ও বেশিরভাগের নাগালের বাইরে৷ তাই বলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়, পরষ্পরের প্রতি ভালোবাসার আদান-প্রদান তো আর বন্ধ ছিল না৷ তখন শুভেচ্ছা বিনিময় হতো চিঠিতে, রঙ-বেরঙয়ের ঈদ কার্ডে৷

বইয়ের দোকানে তাক ভরে সাজিয়ে রাখা সুন্দর সুন্দর ঈদ কার্ড কিংবা পাড়ার মোড়ে রাস্তার পাশের অস্থায়ী ছোট ছোট দোকান৷ তাতে দড়িতে টাঙানো নানা রঙের, নানা নকশা করা মিনি ঈদ কার্ড৷ রোজার মাস এলেই বেড়ে যেত সেসব কার্ডের কদর৷ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ছোটদের মাঝে বিনিময় হতো দৃষ্টিনন্দন কার্ড৷ কে কতগুলো ঈদ কার্ড পেয়েছে সে নিয়ে ছোটদের মাঝে চাপা উত্তেজনা৷

বাহারি রং আর নকশার সেসব কার্ডে থাকতো চাঁদ, তারা, মসজিদ, গম্বুজ, কাবাঘর, কার্টুন, তারকাদের ছবি৷ তার মাঝে বাংলা, ইংরেজি বা আরবিতে লেখা থাকতো ঈদ মোবারক৷ কখনো কখনো সেসব কার্ড হতো কয়েক স্তরের৷ কোনো কোনোটি খুললে খুব সুরেলা মিউজিক বেজে উঠতো, যা শুনলে মন জুড়িয়ে যেতো৷ কোনো কোনোটি থেকে বের হতো মিষ্টি সুবাস৷ তরুণ-তরুণীরা পকেট খরচ বাঁচিয়ে, কিশোর-কিশোরীরা টিফিন খরচ আর ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বাবা-মায়ের হাত ধরে সেসব কার্ড কিনতো৷ একসময় কার্ডের বড় বড় দোকানগুলোতে লম্বা লাইন ধরে লোকজন ঈদ কার্ড কিনতো৷ আর পড়ার ছোট ছোট অস্থায়ী ঈদ কার্ডের দোকানগুলোতে ভিড় জমাতো শিশু-কিশোররা৷

সেসব দিন আর নেই৷ ঈদ কার্ডের রমরমা ব্যবসা থেকে কালক্রমে বিক্রি কমতে কমতে এখন তা প্রায় শূন্যের কোটায় এসে পৌঁছেছে৷ ঈদ কার্ড বেচা-বিক্রির কী অবস্থা তা জানতে রোজার শেষ দিকে গিয়েছিলাম ঢাকার পল্টনে৷ এক সময় সেখানে কার্ড প্রস্তুতকারী নামি-দামি কোম্পানির শো-রুমের পাশাপাশি কার্ড বিক্রির বেশ কয়েকটি ছোট দোকান ছিল৷ এবার দু-একটি বড় কোম্পানির শো-রুম ছাড়া ছোট ছোট দোকান তেমন করে চোখে পড়লো না৷ বিক্রি নেই দেখে তারা হয়তো অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন৷

পুরানা পল্টন চৌরাস্তার মোড় ধরে সামনে এগোলে হাতের বাঁয়ে ফলের টঙ দোকানগুলোর পাশেই দেখা মেলে আইডিয়াল প্রোডাক্টসের শো-রুমের৷ চাপা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই বড় একটি কক্ষে বোঝাই করা নানা ধরনের কার্ড৷ তার মাঝে এককোণে নিতান্ত অবহেলায় স্তুপ করে রাখা কিছু ঈদ কার্ড৷ তাকে তাদের জায়গা মেলেনি৷ দোকানে ভিড় একদমই নেই৷ কয়েকজন বিক্রয়কর্মী একজন মাত্র গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলছেন৷ তিনি কোনো একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ঈদের পর কিছু কার্ড নেবেন৷ সেগুলোর অর্ডার করতে এসেছেন৷ কথা হয় দোকানের তত্ত্বাবধানে থাকা দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে৷ বলেন, "ঈদ কার্ডের প্রচলন আগে যেমন ছিল এখন আর তেমন নেই৷ মোবাইলের কারণে আমাদের ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে৷ সারাদিনে পাঁচ-ছয়টা কার্ডও বিক্রি হয় না৷

"শুধু কিছু বিয়ের কার্ড বিক্রি হয়৷ আমাদের একসময় আট-দশটা শো-রুম ছিল৷ এখন চার-পাঁচটা কোনো মতে টিকে আছে৷ মালিক তা-ও রাখতে চাইছেন না৷ লাভ হয় না, তাই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে চাইছেন৷”

এখন মূলত বিয়ের কার্ড বিক্রি করে তারা কোনো মতে টিকে আছেন৷ বিয়ের কার্ডের বিক্রিও অর্ধেকে নিচে নেমে এসেছে বলে জানান তিনি৷

পাশেই বিখ্যাত আজাদ প্রডাক্টস এর শো-রুম৷ সেখানে গিয়েও একই চিত্র চোখে পড়লো৷ দোকান একেবারেই খালি৷ আমি প্রবেশের পর সানজিদা নামে এক তরুণী প্রবেশ করেন৷ তিনি থাকেন ঢাকার রামপুরায়৷ কথা হয় তার সঙ্গে৷ তিনি জানান, তিনি এখানে বিয়ের কার্ড দেখতে এসেছেন৷ ঈদ কার্ড কেনেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "ছোটবেলায় অনেক কিনতাম৷ কিন্তু এখন বড় হওয়ার পর ঈদ কার্ড নিয়ে ওই আবেগ হারিয়ে গেছে৷ আগে মানুষকে কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতাম৷ এখন ফোন ও ইন্টারনেট আসার পর কল করে বা ম্যাসেজ দিয়েই শুভেচ্ছা জানানো হয়৷ যে কারণে ঈদ কার্ডের ব্যবহার কমে গেছে৷ এখন ঈদ কার্ড একদমই কেনা হয় না৷”

শো-রুমটির ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সেলিমও জানান, ব্যক্তি পর্যায়ে ঈদ কার্ডের বিক্রি শূন্যে নেমে এসেছে৷ এখন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য সামান্য কিছু কার্ড নেয়া হয়৷”

শৈশবে ঈদ কার্ডের স্মৃতি নিয়ে কথা হয় ঢাকার শংকরের বাসিন্দা সাবরিনা সুলতানা পিংকির সঙ্গে৷ পেশাজীবী এই নারী বলেন, ছোটবেলায় স্কুলের বন্ধুদের দেওয়ার জন্য বা কাজিনদের দেওয়ার জন্য অনেক ঈদ কার্ড কিনতেন৷ নায়ক-নায়িকার ছবি বা চাঁদ-তারার ছবির ঈদ কার্ড৷

তিনি বলেন, "মনে আছে এক টাকা/দুই টাকা দিয়ে ঈদ কার্ড কিনতাম৷ ওই টাকা জোগাড় করতে কত কষ্ট হতো৷ চারআনা-আটআনা করে জমাতাম৷ ঈদ কার্ড কিনবো বলে৷ ভাই-বোনদের ক্ষেপাতে কখনো কখনো ওদের উদ্ভট ঈদ কার্ডও দিতাম৷ এ সবই আসলে স্মৃতি৷ শৈশবের আনন্দময় স্মৃতি৷ সেগুলোর কথা এখন বড়বেলায় মনে হলে দারুণ এক আবেশে ভরে যায় মন৷

"এখনকার বাচ্চারা এসব করে না৷ ওদের কোনো স্মৃতি জমা হচ্ছে না৷ ওদের সবকিছু জমা হয় মোবাইলে৷ এজন্য দায়ী আসলে আমরা, বড়রা৷ আমরা তো ওদের ঈদ কার্ড কিনে দিতে পারি বা বানাতে বলতে পারি৷ যেগুলোতে নানা কথা লিখে ওরা বন্ধুদের, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদের শুভেচ্ছা জানাবে৷ এভাবে ওদেরও স্মৃতি জমা হবে৷ বড় হলে যেসব স্মৃতি মনে করে ওরা আনন্দ পবে৷”

সাবরিনা সুলতানা কথাটা কিন্তু দারুণ বলেছেন৷ শৈশবে ঈদ কার্ডে শুভেচ্ছা বিনিময় করা প্রজন্মই আজকের বাবা-মা৷ তারা চাইলে কিন্তু পারেন তাদের শৈশবের সেই দিনগুলো সন্তানদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে৷ সেই শুভেচ্ছা বিনিময়, সেই ভালোবাসা বিনিময়…৷ কে কত ঈদ কার্ড পেলো তা নিয়ে চাপা উত্তেজনায় ঘুম উড়ে যাওয়ার দিনগুলো আবার ফিরে আসুক৷

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান